‘মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল’– তপনের কেন এমন অনুভূতি হয়েছিল?
Share
Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.
আমরা চাই , যাদের জ্ঞান রয়েছে ও যাদের প্রয়োজন তাদের সাথে যোগাযোগ করাতে , বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সহ লোকদের একত্রিত করতে , যাতে তারা একে অপরকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারে এবং প্রত্যেককে তাদের জ্ঞান শেয়ার করে নেয়।
Apurba maity
উদ্ধৃতাংশ টি আশাপূর্ণা দেবীর লেখা জ্ঞানচক্ষু থেকে নেওয়া হয়েছে। তপন যখন তার গরমের ছুটিতে তার মামার বাড়িতে গিয়েছিল তখন সে তার মায়ের চাপে পড়ে তার হোমটাস্ক এর খাতা নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। একদিন এক নিথর,শান্ত দুপুরে সে একা সেই খাতা নিয়ে ছাদে চলে গেল এবং সেখানে গিয়েছে বসে বসে লিখে ফেলো আসতো একটা গল্প। তার নিজের লেখা গল্প পড়ে তার মাথার সব চুল খাড়া হয়ে গেল। এই সময় তার মনে একটু উদ্বেগজনক মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছিল যেহেতু এটা ছিল তার প্রথম সৃষ্টি ।
Aditya Mondal
বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক আশাপুর্ণা দেবী রচিত জ্ঞানচক্ষু গল্পে এক অন্যতম চরিত্র হল তপন যার লেখক সমন্ধে ধারণা ছিল যে লেখকেরা অন্য গ্রহ থেকে আসা জীব কিন্তু তার ছোটোমাসি বিয়ে এক লেখক এর সাথে যিনি এখন তপনের মেসো। সদ্যবিবাহিত তপনের মেসো বাবা কাকাদের মতো স্নান করা, খাওয়া, সিনেমা দেখা, বেড়াতে যাওয়া তপন উপলদ্ধি করে যে লেখকেরা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। এইভাবে তপন মনে করে তার লেখক হতে বাধা কীসের তাই সে মামার বাড়িতে দুপুরবেলা সবাই যখন নিথর তপন আস্তে আস্তে হোম টাস্কের খাতা নিয়ে তিনতলার সিঁড়িতে উঠে একাসনে বসে লিখল একটি গল্প। লেখা যখন পড়ল তপনের গায়ে কাঁটা ও মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। সে ভাবে তার লেখা হুবুহু গল্পের মতো।তার মানে যে সে সত্যিকারের গল্প লিখে ফেলেছে এখন তাহলে তাকে লেখক বলা চলে। এই কথা ভেবে তপন এক উওেজনা অনুভব করে ও আনন্দ হয় তাই তপনের মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল।
Nahid class-3
কথাটা শুনে তপনের চোখ মার্বেল হয়ে গেল !
নতুন মেসোমশাই, মানে যাঁর সঙ্গে এই কদিন আগে তপনের ছোটোমাসির বিয়ে হয়ে গেল দেদার ঘটাপটা করে, সেই তিনি নাকি বই লেখেন । সে সব বই নাকি ছাপাও হয় । অনেক বই ছাপা হয়েছে মেসোর ।
তার মানে —তপনের নতুন মেসোমশাই একজন লেখক । সত্যিকার লেখক ।
জলজ্যান্ত একজন লেখককে এত কাছ থেকে কখনো দেখেনি তপন, দেখা যায়, তাই জানতো না । লেখকরা যে তপনের বাবা, ছোটোমামা বা মেজোকাকুর মতো মানুষ, এবিষয়ে সন্দেহ ছিল তপনের ।
কিন্তু নতুন মেসোকে দেখে জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল তপনের ।
আশ্চর্য, কোথাও কিছু উলটোপালটা নেই, অন্য রকম নেই, একেবারে নিছক মানুষ ! সেই ওঁদের মতোই দাড়ি কামান, সিগারেট খান, খেতে বসেই ‘আরে ব্যস, এত কখনো খাওয়া যায় ?’ বলে অর্ধেক তুলিয়ে দেন, চানের সময় চান করেন এবং ঘুমের সময় ঘুমোন ।
তাছাড়া—
ঠিক ছোটো মামাদের মতোই খবরের কাগজের সব কথা নিয়ে প্রবলভাবে গল্প করেন, তর্ক করেন, আর শেষ পর্যন্ত ‘এ দেশের কিচ্ছু হবে না’ বলে সিনেমা দেখতে চলে যান, কী বেড়াতে বেরোন সেজেগুজে ।
মামার বাড়িতে এই বিয়ে উপলক্ষেই এসেছে তপন, আর ছুটি আছে বলেই রয়ে গেছে । ওদিকে মেসোরও না কী গরমের ছুটি চলছে । তাই মেসো শ্বশুরবাড়িতে এসে রয়েছেন কদিন। তাই অহরহই জলজ্যান্ত একজন লেখককে দেখবার সুযোগ হবেই তপনের । আর সেই সুযোগেই দেখতে পাচ্ছে তপন, ‘লেখক’ মানে কোনো আকাশ থেকে পড়া জীব নয়, তপনদের মতোই মানুষ ।
তবে তপনেরই বা লেখক হতে বাধা কী ?
মেসোমশাই কলেজের প্রফেসার, এখন ছুটি চলছে তাই সেই সুযোগে শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গেছেন কদিন । আর সেই সুযোগেই দিব্যি একখানি দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন । ছোটোমাসি সেই দিকে ধাবিত হয় ।
তপন অবশ্য ‘না আ-আ-‘ করে প্রবল আপত্তি তোলে, কিন্তু কে শোনে তার কথা ?
ততক্ষণে তো গল্প ছোটোমেসোর হাতে চলেই গেছে । হইচই করে দিয়ে দিয়েছে ছোটোমাসি তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে ।
তখন অবশ্য মাসির এই হইচইতে মনে মনে পুলকিত হয় ।
মুখে আঁ আঁ করলেও হয় ।
কারণ লেখার প্রকৃত মূল্য বুঝলে নতুন মেসোই বুঝবে । রত্নের মূল্য জহুরির কাছেই ।
একটু পরেই ছোটোমেসো ডেকে পাঠান তপনকে এবং বোধকরি নতুন বিয়ের শ্বশুরবাড়ির ছেলেকে খুশি করতেই বলে ওঠেন, ‘তপন, তোমার গল্প তো দিব্যি হয়েছে । একটু ‘কারেকশান’ করে ইয়ে করে দিলে ছাপতে দেওয়া চলে ।’
তপন প্রথমটা ভাবে ঠাট্টা, কিন্তু যখন দেখে মেসোর মুখে করুণার ছাপ, তখন আহ্লাদে কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় ।
‘তা হলে বাপু তুমি ওর গল্পটা ছাপিয়ে দিও— মাসি বলে, ‘মেসোর উপযুক্ত কাজ হবে সেটা ।’
মেসো তেমনি করুণার মূর্তিতে বলেন, ‘তা দেওয়া যায় ! আমি বললে ‘সন্ধ্যাতারার’ সম্পাদক ‘না’ করতে পারবে না । ঠিক আছে; তপন, তোমার গল্প আমি ছাপিয়ে দেবো ।’
বিকেলে চায়ের টেবিলে ওঠে কথাটা ।
আর সবাই তপনের গল্প শুনে হাসে । কিন্তু মেসো বলেন,’ না -না আমি বলছি— তপনের হাত আছে । চোখও আছে । নচেৎ এই বয়সের ছেলেমেয়েরা গল্প লিখতে গেলেই তো— হয় রাজারানির গল্প লেখে, নয় তো— খুন জখম অ্যাকসিডেন্ট, অথবা না খেতে পেয়ে মরে যাওয়া, এইসব মালমশলা নিয়ে বসে । তপন যে সেই দিকে যায়নি, শুধু ওর ভরতি হওয়ার দিনের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির বিষয় নিয়ে লিখেছে, এটা খুব ভালো । ওর হবে ।’
তপন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় ।
তারপর ছুটি ফুরোলে মেসো গল্পটি নিয়ে চলে গেলেন । তপন কৃতার্থ হয়ে বসে বসে দিন গোনে ।
এই কথাটাই ভাবছে তপন রাত-দিন । ছেলেবেলা থেকেই তো রাশি রাশি গল্প শুনেছে তপন আর এখন বস্তা বস্তা পড়ছে, কাজেই গল্প জিনিসটা যে কী সেটা জানতে তো বাকি নেই ?
শুধু এইটাই জানা ছিল না, সেটা এমনই সহজ মানুষেই লিখতে পারে । নতুন মেসোকে দেখে জানল সেটা ।
তবে আর পায় কে তপনকে ?
দুপুরবেলা, সবাই যখন নিথর নিথর, তখন তপন আস্তে একটি খাতা ( হোম টাস্কের খাতা আর কী ! বিয়ে বাড়িতেও যেটি মা না আনিয়ে ছাড়েননি ।) আর কলমটি নিয়ে তিনতলার সিঁড়িতে উঠে গেল, আর তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, একাসনে বসে লিখেও ফেলল আস্ত একটা গল্প ।
লেখার পর যখন পড়ল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তপনের, মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল ।
একী ব্যাপার !
এ যে সত্যিই হুবহু গল্পের মতোই লাগছে ! তার মানে সত্যিই একটা গল্প লিখে ফেলেছে তপন । তার মানে তপনকে এখন ‘লেখক’ বলা চলে ।
হঠাৎ ভয়ানক একটা উত্তেজনা অনুভব করে তপন, আর দুদ্দাড়িয়ে নীচে নেমে এসে—ছোটোমাসিকেই বলে বসে, ‘ছোটোমাসি, একটা গল্প লিখেছি ।’
ছোটোমাসিই ওর চিরকালের বন্ধু, বয়সে বছর আষ্টেকের বড়ো হলেও সমবয়সি, কাজেই মামার বাড়ি এলে সব কিছুই ছোটোমাসির কাছে । তাই এই ভয়ানক আনন্দের খবরটা ছোটোমাসিকে সর্বাগ্রে দিয়ে বসে ।
তবে বিয়ে হয়ে ছোটোমাসি যেন একটু মুরুব্বি মুরুব্বি হয়ে গেছে, তাই গল্পটা সবটা না পড়েই একটু চোখ বুলিয়েই বেশ পিঠ চাপড়ানো সুরে বলে, ‘ওমা এ তো বেশ লিখেছিস রে ? কোনোখান থেকে টুকলিফাই করিসনি তো ?
‘আঃ ছোটোমাসি, ভালো হবে না বলছি ।’
‘আরে বাবা খেপছিস কেন ? জিজ্ঞেস করছি বই তো নয় ! রোস তোর মেসোমশাইকে দেখাই— ।’
কিন্তু গেলেন তো— গেলেনই যে ।
কোথায় গল্পের সেই আঁটসাঁট ছাপার অক্ষরে গাঁথা চেহারাটি ? যার জন্যে হাঁ করে আছে তপন ? মামার বাড়ি থেকে বাড়িতে চলে এসেও ।
এদিকে বাড়িতে তপনের নাম হয়ে গেছে, কবি, সাহিত্যিক, কথাশিল্পী । আর উঠতে বসতে ঠাট্টা করছে ‘তোর্ হবে । হাঁ বাবা তোর হবে ।’
তবু এইসব ঠাট্টা-তামাশার মধ্যেই তপন আরো দু’তিনটে গল্প লিখে ফেলেছে । ছুটি ফুরিয়ে এসেছে, হোম টাস্ক হয়ে ওঠেনি, তবু লিখছে । লুকিয়ে লিখছে । যেন নেশায় পেয়েছে ।
তারপর ছুটি ফুরোল, রীতিমতো পড়া শুরু হয়েছে । প্রথম গল্পটি সম্পর্কে একেবারে আশা ছাড়া হয়ে গেছে, বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছে এমন সময় ঘটল সেই ঘটনা ।
ছোটোমাসি আর মেসো একদিন বেড়াতে এল, হাতে এক সংখ্যা ‘সন্ধ্যাতারা’ ।
কেন ? হেতু ? ‘সন্ধ্যাতারা’ নিয়ে কেন ?
বুকের রক্ত ছলকে ওঠে তপনের ।
তবে কী ? সত্যিই তাই ? সত্যিই তপনের জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনটি এল আজ ?
কিন্তু তাই কী সম্ভব ? সত্যিকার ছাপার অক্ষরে তপন কুমার রায়ের লেখা গল্প, হাজার-হাজার ছেলের হাতে হাতে ঘুরবে ?
পৃথিবীতে এমন অলৌকিক ঘটনাও ঘটে ?
তা ঘটেছে, সত্যিই ঘটেছে ।
সূচিপত্রেও নাম রয়েছে ।
‘প্রথম দিন’ (গল্প) শ্রীতপন কুমার রায় ।
সারা বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায়, তপনের লেখা গল্প পত্রিকায় ছাপা হয়েছে । ওর লেখক মেসো ছাপিয়ে দিয়েছে ! পত্রিকাটি সকলের হাতে হাতে ঘোরে, সকলেই একবার করে চোখ বোলায় আর বলে, ‘বারে, চমৎকার লিখেছে তো ।’
মেসো অবশ্য মৃদু হাসেন, বলেন, ‘একট-আধটু ‘কারেকশান’ করতে হয়েছে অবশ্য । নেহাত কাঁচা তো ?’
মাসি বলে, ‘তা হোক, নতুন নতুন অমন হয়—’
ক্রমশ ও কথাটাও ছড়িয়ে পড়ে ।
ওই কারেকশানের কথা ।
বাবা বলেন, ‘তাই । তা নইলে ফট করে একটা লিখল, আর ছাপা হলো,—’
মেজোকাকু বলেন, ‘তা ওরকম একটি লেখক মেসো থাকা মন্দ নয় । আমাদের থাকলে আমরাও চেষ্টা করে দেখতাম । ‘
Subhamoy
একদিন তপন বাড়িতে দুপুরবেলা সবাই যখন নিথর তখন আস্তে আস্তে হোম টাস্কের খাতা নিয়ে তিনতলার সিঁড়িতে উঠে একাসনে বসে লিখল একটি গল্প। লেখা যখন পড়ল তপনের গায়ে কাঁটা ও মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। সে ভাবে তার লেখা হুবুহু গল্পের মতো । এই কথা ভেবে তপন এক উওেজনা অনুভব করে ও আনন্দ হয় তাই তপনের মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল।